ফেলে আসা মধুময় স্মৃতির গহীন থেকে।
রিয়াজ আলম
 |
| রিয়াজ আলম |
ছোটকাল থেকে আমি খুব আড্ডাপ্রিয় ছিলাম। আমার ছোটবেলার খুব প্রিয় এবং কাছের বন্ধু ছিল ইকবাল,কবির,আকমাল,আক্তার,মছব্বির,নুরুল,সালেক ভাই,সুন্দর আলী,সুফিয়ান সহ আরো অনেকেই যাদের সাথে আমি খুব আড্ডা দিতাম। বিশেষ করে আমি আর ইকবাল আমাদের ছোটকালের প্রতিটি মুহুর্ত একত্রে কাটিয়েছি। দুইজন একসাথে গ্রামের মেটোপথ ধরে দিন কিংবা রাতে একত্রে হেঁটেছি, জীবনের ভাললাগা,ভালবাসার গল্প শেয়ার করেছি। একত্রে দুইজন আমার মামার বাড়ী পলাশ কিংবা তার মামার বাড়ী বিশ্বম্ভরপুর সহ অনান্য আত্বিয়দের বাড়ীতে কত যে বেড়িয়েছি যার কোন সিমাবদ্ধতা নেই। দেখা গেছে ইকবাল যদি আমাদের বাড়ীতে আসছে তাহলে ঐইদিন আমাদের বাড়ীতেই থাকা খাওয়া অথবা ওদের বাড়ীতে গেলে ঐইদিন ওদের বাড়ীতেই থাকা খাওয়া ব্যবস্থা হতো। তাদের বাড়ীর রাস্তায় কিংবা গ্রামের রাস্তায় বসে দিনের পর দিন আড্ডা দিয়েছি মনের কথ কথা শেয়ার করেছি,কোন মেয়েটা আমাদের দেখে একটু হাসল কোন মেয়েটা আমাদের দেখে একটু প্রশংসা করল এই সবই ছিল আড্ডার মূল বিষয় বস্তু। ১৯৯৯ সালে ইকবাল এঁর সেনাবাহিনীতে চাকুরী হলে সে আমাদের ছেরে চলে যায় আমি তখন কিছুটা হলেও একা হয়ে যাই। কারণ ইকবাল সাহেবই হল আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং আত্বার বন্ধু। অদ্যাবধি আমাদের বন্ধুত্ব অটুট আছে। ২০০১ সালে আমি জীবিকার তাগিদে আমার প্রিয় শহর,জল-জোসনার শহর, কবিতার শহর, সুনামগন্জ ছেরে চলে আসি। আমি তখন সুনামগন্জ শহরের হাছননগর থেকে লেখাপড়া করতাম। সেই যে প্রিয় শহর, প্রিয় গ্রাম,প্রিয় চেনাজানা মেটোপথ,প্রিয় সুরমা নদী ছারলাম, আজও আর ফেরা হয়নি কর্তব্য কর্ম আর কঠিন দায়িত্ববোধের কারনে। যদিও বা মাঝে মধ্যে এক দুই দিনের জন্য বাড়ীতে যাই কিন্তু সেই প্রিয় মুখগুলি খুব বেশী দেখা হয়না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্থ, কেউ জীবিকার তাগিদে ইউরোপে,কেউ মিডিলিষ্টে,কেউ চাকুরীতে কেউ বা ব্যবসায়ী। কেহই কাউকে সময় দিতে পারেনা। জানিনা আর কবে বাড়ী ফিরবো আদৌকি আর আগের মতো হই-হল্লুর করা জীবন ফিরে পাবো। বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলা, পুকুরে অবাধ সাতার, হাওরে মাছধরা, রাতে টর্চ লাইটের আলোতে মাছ শিকার করা, চৈত্র কিংবা জৈষ্ট্য মাসে গ্রামে যাত্রাগান দেখা, মালজুরা দেখা, বর্ষাকালে কুস্তি খেলা,কাবাডি খেলা এসব কেবলী স্মৃতি। হৃদয়ের মণিকোঠায় এসব স্মৃতি এসে মাঝে মধ্যে খুব নাড়াদেয়,আমি হাফিয়ে উঠি । ইচ্ছা করে সব কিছু ছেরে আমার সেই চির-চেনাজানা পরিবেশে ফিরে যাই, যেখানে শাষন-শোষনের কোন তুয়াক্কা থাকবেনা। থাকবেনা আইনের বেড়াজালে আবদ্ধ জীবন। জীবনের এই পর্যায়ে এসে ঘুরে বেরিয়েছি বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগের প্রায় সবকটি জেলায়,গিয়েছি নামনাজানা অসংখ্য অগনিত গ্রামে, পরিচিত হয়েছি অনেক সমাজ,সভ্যতা আর সংসারের সাথে, অনেকেরর সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে যাদের স্থান আত্বার অনেক গভীরে। তবুও মনে সব সময় বয়ে বেড়ায় শৈশবের সেই মধুময় দিনগুলির স্মৃতি। রাতের আধারে কাউকে না বলে বিশ্বম্ভরপুর যেয়ে সুফিয়ানদের ফটিকে ঘুমানো সকালে ফটিকের দরজা খুলে তাঁরা সবাই আমাদের দেখে বিস্মিত হওয়া সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দেয়া আর মজার মজার খাবার খাওয়া। আবার কখনও কখনও গভীর রাতে সাদা-পান্জাবী পরে মুক্তিখলার রাস্তা দিয়ে পলাশ গিয়ে জোসনার আলোতে সুন্দর আলীকে ভয় দেখানো,বন্যায় কল্লোলের মধ্যে বেলুনের নৌকায় আমি আর সুন্দর আলীর পলাশ গ্রামের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো এসব স্মৃতি আমাকে খুব পীড়া দেয়। জানিনা কবে পরিপূর্ণরুপে বাড়ী ফিরবো নাকি করোনার এই করাল গ্রাসে একদিন লাল নিশানা করে সরকারী এম্বোলেন্সে হুইসেল বাজিয়ে চিরদিনের জন্য আমায় বাড়ী নিয়ে যাবে, চিরকালের জন্য আমায় ঘুম পারিয়ে দিবে না ফেরারদেশে। থেমে যাবে জীবনের সমস্ত কোলাহল। এমন কিছুই করতে পারিনি মানুষের জন্য যার প্রেক্ষিতে মানুষ আমায় চিরকাল স্মরন রাখবে। হয়তো একদিন দুইদিন, একমাস দুইমাস, একবছর দুইবছর, পাচঁবছর দশবছর,এর পরে কেউ হয়তো আমায় আর স্মরন করবেনা, ভুলে যাবে। শতাব্দীর গহব্বরে বিলিন হয়ে যাব আমি রিয়াজ। একশত বছর পরে হয়ত কেউ জানবেও না রিয়াজ নামক কোন ব্যাক্তি এই ধরাধামে ছিল,কালের আবর্তে আমি হারিয়ে যাব দূর নীলিমায়।